Header Ads Widget

সূরা ফালাক ও সূরা নাস এর শানে নুযূল

সূরা ফালাক সূরা নাস উভয় সূরার নামকরণ করা হয়েছে সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত শব্দ থেকে। ফালাক (الفلق) শব্দের অর্থ : প্রভাতকাল। আর নাস (النَّاس) অর্থ : মানুষ। দুই সূরাকে একত্রে معوذتان বা আশ্রয় প্রার্থনা করার দুই সূরা বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জাদুগ্রস্থ হওয়ার পর সূরাদ্বয় দ্বারা ঝাড়ফুঁক করা হলে আল্লাহ তাআলার রহমতে তিনি সুস্থ হন, তাই নামেও সূরাদ্বয় পরিচিত।


 

শানে নুযূল: মা আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, মদীনার ইয়াহূদী গোত্র বনু যুরাইকের মিত্র লাবীদ বিন আসাম নামক জনৈক মুনাফিক তার মেয়েকে দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মাথার ছিন্নচুল চিরুনীর ছিন্ন দাঁত চুরি করে এনে তাতে জাদু করে এবং মন্ত্র পাঠ করে চুলে ১১টি গিরা দেয়। এর প্রভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কোন কাজ করলে ভুলে যেতেন ভাবতেন যে করেননি। অন্য বর্ণনা মতে ৪০ দিন বা মাস এভাবে থাকেন। এক রাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বপ্নে দেখেন যে, দুজন লোক এসে একজন তাঁর মাথার কাছে অন্যজন পায়ের কাছে বসে। অতঃপর তারা বলে যে, বনু যুরাইকের খেজুর বাগানে যারওয়ান কূয়ার তলদেশে পাথরের নীচে চাপা দেয়া খেজুরের কাঁদির শুকনো খোসার মধ্যে জাদু করা চুল চিরুনীর দাঁত রয়েছে। ওটা তুলে এনে গিরা খুলে ফেলতে হবে। রাসূল (সাঃ) সকালে আলী (রাঃ)-কে সেখানে পাঠান এবং যথারীতি তা তুলে আনা হয়। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) সূরাদ্বয় পড়ে ফুঁ দিয়ে গিরাগুলো খুলে ফেলেন এবং তিনি সুস্থ হয়ে যান। (সহীহ বুখারী হা. ৫৭৬৫, ৫৭৬৬)  

আয়িশাহ (রাঃ) হতে অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসূল (সাঃ)-এর যাদুকৃত চুল চিরুনীর দাঁত উদ্ধার হওয়ার পর সূরা ফালাক নাস নাযিল হয়। যার ১১টি আয়াতের প্রতিটি আয়াত পাঠের সাথে সাথে জাদুকৃত ১১টি চুলের গিরা পরপর খুলে যায় এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হালকা বোধ করেন সুস্থ হয়ে যান। (ইবনু কাসীর) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে প্রতিশোধ নিতে বলা হলে তিনি বলেন : আল্লহ আমাকে আরোগ্য দান করেছেন। আমি অপছন্দ করি যে, মানুষের মাঝে খারাপ কিছু ছড়িয়ে দেওয়া হোক। (সহীহ বুখারী হা. ৬৩৯১)  

 গুরুত্ব: ওকবা বিন আমের আল যুহানী (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : আমার কাছে এমন কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে যার অনুরূপ আর দেখা যায়নি। তাহলো সূরা ফালাক সূরা নাস। (সহীহ মুসলিম হা. ৮১৪) অন্য বর্ণনাতে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : তুমি কি জান আজ রাতে এমন কিছু আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে যার সদৃশ ইতোপূর্বে কখনই দেখা যায়নি। তাহলো সূরা ফালাক নাস। (সহীহ মুসলিম হা. ৮১৪) ফযীলত: আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সাঃ) প্রত্যেক রাতে যখন বিছানায় যেতেন তখন দু হাত একত্রিত করে ফুঁ দিতেন, অতঃপর সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক সূরা নাস পাঠ করতেন। তারপর যথাসম্ভব দু হাত দিয়ে শরীর মাসাহ করতেন। তিনি প্রথমে মাথা, মুখমন্ডল শরীরের সম্মুখ ভাগ থেকে শুরু করতেন। (সহীহ বুখারী হা. ৫০১৭)  

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জিন মানুষের চোখ লাগা হতে আশ্রয় চাইতেন কিন্তু যখন সূরা ফালাক নাস অবতীর্ণ হলো তখন তিনি সব বাদ দিয়ে দুটিই পড়তে থাকেন। (সূরা কালামের তাফসীর দ্রষ্ট্যব্য) উকবা বিন আমের (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে প্রতি সালাতের শেষে সূরা ফালাক নাস পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন। (তিরমিযী হা. ২৯০৩ আবূ দাঊদ হা. ১৫২, মিশকাত হা. ৯৬৯) আয়িশাহ (রাঃ) বলেন : যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অসুখে পড়তেন, তখন সূরা ফালাক নাস পড়ে ফুঁক দিয়ে নিজের দেহে হাত বুলাতেন। কিন্তু যখন ব্যাথা-যন্ত্রণা অসহনীয় হয়ে যেত তখন বরকতের আশায় আমি তাঁর দেহে হাত বুলিয়ে দিতাম। মুসলিমের বর্ণনায় রয়েছে : পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে সূরা ফালাক নাস পড়ে ফুঁক দিতেন। (সহীহ বুখারী হা. ৫০৯২, সহীহ মুসলিম হা. ২১৯২) একদা ওকবা বিন আমির (রাঃ)-কে নাবী (সাঃ) বলেন : হে ওকবা! আমি কি তোমাকে শ্রেষ্ঠ দুটি সূরা শিক্ষা দেব না? অতঃপর তিনি আমাকে সূরা ফালাক নাস শিক্ষা দিলেন। তারপর তিনি সালাতের ইমামতি করেন এবং সূরাদ্বয় পাঠ করলেন। সালাত শেষে আমাকে বললেন : হে ওকবা! তুমি দুটি সূরা পাঠ করবেÑযখন ঘুমাবে এবং যখন ঘুম থেকে জাগবে। (আহমাদ হা. ১৭৩৩৫, নাসায়ী হা. ৫৪৩৭, সহীহুল জামে হা. ৭৯৪৮) ছাড়াও সূরাদ্বয়ের ফযীলত সম্পর্কে অনেক সহীহ হাদীস পাওয়া যায়। জাদু টোনা, ঝাড়ফুঁক তাবীজ কবচ : ইসলামে জাদু হারাম। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে দূরে থাক। তার মধ্যে অন্যতম হলো জাদু। (সহীহ বুখারী হা. ২৭৬৬, সহীহ মুসলিম হা. ৮৯) ইসলামে ঝাড়-ফুঁক সিদ্ধ তবে অবশ্যই সে ঝাড়-ফুঁক কুরআন সহীহ সুন্নাহ অনুপাতে হতে হবে। 

 যেমন সূরা ফালাক, নাস ইখলাস ইত্যাদি এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে যে সকল দু প্রমাণিত। যেমন بِاسْمِ اللّٰهِ أَرْقِيكَ، مِنْ كُلِّ شَيْءٍ يُؤْذِيكَ، مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنِ حَاسِدٍ، اللّٰهُ يَشْفِيكَ بِاسْمِ اللّٰهِ أَرْقِيكَ আমি আল্লাহ তাআলার নামে আপনাকে ঝেড়ে দিচ্ছি এমন সব বিষয় হতে যা আপনাকে কষ্ট দেয়। প্রত্যেক হিংসুক ব্যক্তির বা হিংসুক চোখের অনিষ্ট হতে আল্লাহ তাআলা আপনাকে নিরাময় করুন। আল্লাহ তাআলার নামে আপনাকে ঝেড়ে দিচ্ছি। (সহীহ মুসলিম হা. ২১৮৬) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হাসান হুসাইন (রাঃ)-কে নিম্নোক্ত দুআর মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক করেছেন। أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ، مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ، وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لاَمَّةٍ আমি আল্লাহ তাআলার পূর্ণ বাক্যসমূহের আশ্রয়ে নিচ্ছি প্রত্যেক শয়তান হতে, বিষাক্ত কীট পতঙ্গ প্রত্যেক অনিষ্টকারীর চক্ষু হতে। (সহীহ বুখারী হা. ৩৩৭১)  

ছাড়াও ঝাড়-ফুঁকের অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে। কিন্তু যদি ঝাড় ফুঁক কুরআন বা সহীহ সুন্নাহ অনুপাতে না হয়ে অন্য কোন বানোয়াট শির্কী কথা দ্বারা হয় তাহলে তা সম্পূর্ণ হারাম। বিভিন্ন বালা-মসিবত থেকে বাঁচার জন্য বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে তাবিজ ঝুলানো বা তাবিজ বাঁধা চাই তা কুরআন দ্বারা হোক আর অন্য কিছু হোক তা সম্পূর্ণ নিষেধ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : যে ব্যক্তি তাবিজ ঝুলালো সে শিরক করল। (আহমাদ হা. ১৭৪৫৮, সিলসিলা সহীহাহ হা. ৪৯২) অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : > مَنْ تَعَلَّقَ شَيْئًا وُكِلَ إِلَيْهِ যে ব্যক্তি কোন কিছু লটকায় তাকে তার দিকেই সোপর্দ করে দেয়া হবে। (তিরমিযী হা. ২০৭২, মিশকাত হা. ৪৫৫৬, সনদ হাসান।) তাই ঝাড়-ফুঁেকর প্রয়োজন হলে একমাত্র কুরআন স্ন্নুাহ দ্বারাই করতে হবে। তাফসীর: (قُلْ أَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ) - الْفَلَقِ অর্থ الصبح বা প্রভাত কাল, উষা। 

 আবার ফালাক অর্থ বিদীর্ণ করা, ফেটে বের হওয়া। যেমন বলা হয় فلقت الشئ أي شققته আমি জিনিসটিকে ফালাক করেছি অর্থাৎ বিদীর্ণ করেছি। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন : (إِنَّ اللّٰهَ فَالِقُ الْحَبِّ وَالنَّوٰي) ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ শস্য-বীজ আঁটি অঙ্কুরিত করেন’ (সূরা আনআম : ৯৫) যেহেতু আল্লাহ তাআলা রাতের অন্ধকার ভেদ করে প্রভাতের আলো বিকশিত করেন, তাই তাকে ফালাক বলা হয়। আল্লাহ তাআলা নাবী (সাঃ)-কে প্রভাতের প্রতিপালকের কাছে, নিজের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করার নির্দেশ দিচ্ছেন। অর্থাৎ এতে ইঙ্গিত রয়েছে সকল অনিষ্টের মূল হলো অন্ধকার। অনিষ্ট দূর হওয়ার পর আসে খুশির প্রভাত। মানুষ যখন বিপদে পতিত হয় তখন চেহারা মলিন অন্ধকার হয়ে যায়। আবার যখন বিপদ থেকে মুক্তি পায় তখন চেহারা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। (شَرِّ مَا خَلَق) অর্থাৎ সকল মাখলুকের অনিষ্ট হতে। হাসান বাসরী (রহঃ) বলেন: জাহান্নাম, শয়তান তার সঙ্গী সাথী যা আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন। (وَمِنْ شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ) - غَاسِق অর্থ: রাত। 

 যেমন হাসান বাসরী কাতাদাহ (রহঃ) বলেন : انه الليل اذا اقبل بظلامه এটা (গাসাক) হলো রাত যখন তা অন্ধকারসহ আগমন করে। (ই্বনু কাসীর) ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন : الغسق اول ظلمة الليل গসাক হলো রাতের প্রথম অন্ধকার। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন : (أَقِمِ الصَّلٰوةَ لِدُلُوْكِ الشَّمْسِ إِلٰي غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْاٰنَ الْفَجْرِ) ‘সূর্য ঢলে পড়ার পর হতে রাত্রির ঘন অন্ধকার পর্যন্তসালাত কায়েম কর এবং কায়েম কর ফজরের সালাত।’ (সূরা ইসরা ১৭ : ৭৮) আবার হাদীসে চাঁদকে غَاسِقٍ বলা হয়েছে। যেমন একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রাতে আয়িশাহ (রাঃ)-এর হাত ধরে চাঁদ দেখিয়ে বলেন : হে আয়িশাহ! এর অনিষ্ট হতে আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা কর। কেননা এটা হলো গাসেক যখন সে সমাগত হয়। (তিরমিযী হা. ৩৩৬৬, মিশকাত হা. ২৪৭৫ সনদ সহীহ।)  

যারা গাসেক বলে রাতকে বুঝিয়েছেন আর যারা চাঁদকে বুঝিয়েছেন উভয়ের মাঝে কোন প্রার্থক্য নেই। কেননা চাঁদ রাতের একটি নিদর্শন। وَقَبَ অর্থ : প্রবেশ করা, চলে যাওয়া ইত্যাদি। অর্থাৎ আমি আশ্রয় চাচ্ছি রাতের অনিষ্ট হতে যখন তা অন্ধকারে প্রবেশ করে। রাতের অন্ধকারেই হিংস্র জন্তু, ক্ষতিকর প্রাণী পোকা মাকড় অনুরূপভাবে অপরাধপ্রবণ হিংস্র মানুষ নিজ নিজ জঘন্য ইচ্ছা পূরণের আশা নিয়ে বাসা হতে বের হয়। বাক্য দ্বারা সে সকল অনিষ্টকর জীব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করার কথা বলা হচ্ছে। (وَمِنْ شَرِّ النَّفَّاثٰتِ فِي الْعُقَدِ) হাসান বাসরী, যহহাক কাতাদাহ (রহঃ) বলেন : النفاثات هن السواحر নাফফাসাত হলো জাদুকারীগণ। 

 আল্লামা শাওকানী (রহঃ) বলেন : গিরাতে ফুঁৎকারদানকারী আত্মার অনিষ্ট হতে অথবা গিরাতে ফুঁৎকারদানকারিণী মহিলাদের থেকে। (ফাতহুল কাদীর) থেকে উদ্দেশ্য হলো : গিরাতে ফুঁক দানকারী প্রত্যেক জাদুকারিণী জাদুকর যারা মানুষের ক্ষতি করে থাকে। حَسَدَ বলা হয়যে ব্যক্তির সাথে হিংসা করা হচ্ছে তাকে আল্লাহ তাআলা যে নেয়ামত দান করেছেন তা দূরীভূত হয়ে যাওয়ার আকাক্সক্ষা করা।’ (ফাতহুল কাদীর) এরূপ হিংসা করা কবীরাহ গুনাহ মারাত্মক ব্যাধি। 

 রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : إِيَّاكُمْ وَالْحَسَدَ، فَإِنَّ الْحَسَدَ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْحَطَبَ তোমরা হিংসা থেকে বেঁেচ থাকে। কেননা হিংসা মানুষের সৎ আমল এমনভাবে খেয়ে ফেলে যেমন আগুন কাঠ খেয়ে ফেলে। (আবূ দাঊদ হা. ৪৯০৩, সহীহ) ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন : হিংসা হলো প্রথম পাপ, যা আসমানে করা হয় এবং প্রথম পাপ যা পৃথিবীতে করা হয়। যা আসমানে ইবলীস আদমের সাথে করেছিল। আর পৃথিবীতে কাবীল তার ছোট ভাই হাবীলের সাথে করেছিল। অতএব হিংসুক ব্যক্তি অভিশপ্ত, বহিস্কৃত প্রত্যাখ্যাত। (তাফসীর কুরতুবী) তাই হিংসাকারীর অনিষ্ট থেকেও আল্লাহ তাআলা নাবী (সাঃ)-কে আশ্রয় প্রার্থনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। হিংসা থেকে বাঁচার উপায় হল বেশি বেশি শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আশ্রয় চাওয়া। এজন্য নিম্নোক্ত দুআটি বেশি বেশি পাঠ করতে হবে।  

আল্লাহ তাআলা বলেন : (رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِيْنَ سَبَقُوْنَا بِالْإِيْمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِيْ قُلُوْبِنَا غِلًّا لِّلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا رَبَّنَآ إِنَّكَ رَؤُوْفٌ رَّحِيْم) “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এবং আমাদের সে-সব ভাইদের ক্ষমা কর যারা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছে এবং মুমিনদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করবেন না। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তো দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু।” (সূরা হাশর ৫৯ : ১০) আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: . সূরা ফালাক নাসের অন্যান্য নাম জানলাম। . দুটি সূরার গুরুত্ব ফযীলত জানলাম। . জাদুটোনা তাবীজ-কবচ শরীয়তে সম্পূর্ণ নিষেধ। . কুরআন সহীহ সুন্নাহ দ্বারা ঝাড়-ফুঁক হলে বৈধ, অন্যথায় তা অবৈধ। . জাদুর প্রভাব রয়েছে যার প্রমাণ নাবী (সাঃ) স্বয়ং নিজে। . ইয়াহূদীরা ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই বিভিন্ন চক্রান্ত অপকৌশল অবলম্বন করে আসছে যা আজও বিদ্যামান। . হিংসা একটি বড় গুনাহ এবং মারাত্মক ব্যাধি যা মানুষের সৎ আমল বিনষ্ট করে দেয়।

আল্লাহ তায়ালা বলেন-

 قُلۡ  اَعُوۡذُ  بِرَبِّ النَّاسِ ۙ﴿۱﴾

বল, ‘আমি আশ্রয় চাচ্ছি মানুষের প্রতিপালকের, - নং আয়াতের তাফসীর সূরায় মহা মহিমান্বিত আল্লাহর তিনটি গুণ বিবৃত হয়েছে। অর্থাৎ তিনি হলেন পালনকর্তা, শাহানশাহ এবং মা'বুদ বা পূজনীয়। সব কিছু তিনিই সৃষ্টি করেছেন, সবই তার মালিকানাধীন এবং সবাই তার আনুগত্য করছে। তিনি তার প্রিয় নবী (সঃ)-কে নির্দেশ দিচ্ছেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি বলে দাও, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি মানুষের প্রতিপালকের, মানুষের অধিপতির এবং মানুষের মা'বুদের, পশ্চাদপসরণকারীর অনিষ্ট হতে যে মানুষের অন্তরসমূহে কুমন্ত্রণা প্ররোচনা দিয়ে থাকে। চাই সে জ্বিন হোক অথবা মানুষ হোক। অর্থাৎ যারা অন্যায় খারাপ কাজকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে চোখের সামনে হাজির করে পথভ্রষ্ট এবং বিভ্রান্ত করার কাজে যারা অতুলনীয়। আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই শুধু তাদের অনিষ্ট হতে রক্ষা পেতে পারে।  

সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃতোমাদের প্রত্যেকের সাথে একজন করে শয়তান রয়েছে।সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেনঃহে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার সাথেও কি শয়তান রয়েছে?” উত্তরে তিনি বললেনঃহ্যা আমার সঙ্গেও শয়তান রয়েছে? কিন্তু আল্লাহ তাআলা শয়তানের মুকাবিলায় আমাকে সাহায্য করেছেন, কাজেই আমি নিরাপদ থাকি। সে আমাকে পুণ্য কল্যাণের শিক্ষা দেয়।সহীহ বুখারী সহীহ মুসলিমে হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর 'তেকাফে থাকা অবস্থায় উম্মুল মু'মিনীন হযরত সফিয়া (রাঃ) তাঁর সাথে রাতের বেলায় দেখা করতে গিয়েছিলেন। তিনি ফিরে যাবার সময় রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাঁকে এগিয়ে দেয়ার জন্যে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকেন। পথে দুজন আনসারীর সাথে দেখা হলো। তারা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর সাথে তাঁর স্ত্রীকে দেখে দ্রুতগতিতে হেঁটে যাচ্ছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাঁদেরকে থামালেন এবং বললেনঃজেনে রেখো যে, আমার সাথে যে মহিলাটি রয়েছে এটা আমার স্ত্রী সফিয়া বিনতে হুইয়াই (রাঃ)তখন আনসারী দুজন বললেনঃআল্লাহ্ পবিত্র। হে আল্লাহর রাসূল (সঃ) কথা আমাদেরকে বলার প্রয়োজনই বা কি ছিল?” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) উত্তরে বললেনঃমানুষের রক্ত। প্রবাহের স্থানে শয়তান ঘোরাফেরা করে থাকে। সুতরাং আমি আশংকা করছিলাম যে, শয়তান তোমাদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করে দেয় না কি।হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনশয়তান তার হাত মানুষের অন্তকরণের উপর স্থাপন করে রেখেছে। মানুষ যখন আল্লাহর ইবাদত করে তখন সে নিজের হাত মানুষের অন্তকরণ থেকে সরিয়ে নেয়। আর যখন মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায় তখন শয়তান মানুষের অন্তকরণের উপর পূর্ণ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এটাই শয়তানের কুমন্ত্রণা প্ররোচনা এবং এটাই ওয়াসওয়াসাতুল খান্নাস।” ( হাদীসটি হাফিয আবূইয়ালা মুসিলী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু হাদীসটি গারীব বা দুর্বল) মুসনাদে আহমাদে এমন একজন সাহাবী হতে বর্ণিত আছে যিনি গাধার পিঠে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর পিছনে উপবিষ্ট ছিলেন। গাধা একটু হোঁচট খেলে সাহাবী বলে ওঠেনঃশয়তান ধ্বংস হোক।তাঁর কথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেনঃএভাবে বলো না, এতে শয়তান আরো বড় হয়ে যায়, আরো এগিয়ে আসে এবং বলেঃ আমি নিজের শক্তি দ্বারা তাকে কাবু করেছি। আর যদি বিসমিল্লাহ বলো তবে সে ছোট হতে হতে মাছির মতে হয়ে যায়। এতে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর স্মরণে শয়তান পরাজিত নিস্তেজ হয়ে যায়। আর আল্লাহকে বিস্মরণ হলে সে বড় হয়ে যায় জয়যুক্ত হয়। 

 হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃতোমাদের মধ্যে কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে শয়তান তার কাছে যায় এবং আদর করে তার গায়ে হাত বুলাতে থাকে, যেমন মানুষ গৃহপালিত পশুকে আদর করে। আদরে লোকটি চুপ করে থাকলে শয়তান তার নাকে দড়ি বা মুখে লাগাম পরিয়ে দেয়।হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হাদীসটি বর্ণনা করে বলেনঃতোমরা স্বয়ং নাকে দড়ি লাগানো এবং মুখে লাগাম পরিহিত লোককে দেখতে পাও। নাকে দড়ি লাগানো হলো ব্যক্তি যে এক দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকে এবং আল্লাহকে স্মরণ করে না। আর মুখে লাগাম পরিহিত হলো ব্যক্তি যে মুখ খুলে রাখে এবং আল্লাহর যিক্র করে না।হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) আয়াতের তাফসীরে বলেন যে, শয়তান আদম সন্তানের মনে তার থাবা বসিয়ে রাখে। 

 মানুষ যেখানেই ভুল করে এবং উদাসীনতার পরিচয় দেয় সেখানেই সে কুমন্ত্রণা দিতে শুরু করে। আর যেখানে মানুষ আল্লাহকে স্মরণ করে সেখানে সে পশ্চাদপসরণ করে। অন্য বর্ণনায় আছে যে, সুখ-শান্তি এবং দুঃখ কষ্টের সময় শয়তান মানুষের মনে ছিদ্র করতে চায়। অর্থাৎ তাকে পথভ্রষ্ট বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করে। সময়ে যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আল্লাহকে স্মরণ করে তবে শয়তান পালিয়ে যায়। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, শয়তানকে মানুষ যেখানে প্রশ্রয় দেয় সেখানে সে মানুষকে অন্যায় অপকর্ম শিক্ষা দেয়, তারপর কেটে পড়ে। এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ মানব মণ্ডলীর অন্তর সমূহে কুমন্ত্রণা দেয়। (আরবি) শব্দের অর্থ মানুষ। তবে এর অর্থ জ্বিনও হতে পারে। কুরআন কারীমের অন্যত্র রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ জ্বিনের মধ্য হতে কতকগুলো তোক।  

কাজেই জ্বিনসমূহকে শব্দের অন্তর্ভুক্ত করা অসঙ্গত নয়। মোটকথা, শয়তান। জ্বিন এবং মানুষের মনে কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে। (আরবি) (জ্বিনের মধ্য হতে অথবা মানুষের মধ্য হতে) অর্থাৎ এরা কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে, চাই সে জ্বিন হোক অথবা মানুষ হোক। এর তাফসীর এরূপও করা হয়েছে। মানব দানব শয়তানরা মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়। যেমন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা অন্য এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎএভাবেই আমি মানবরূপী অথবা দানবরূপী শয়তানকে প্রত্যেক নবীর শত্রু বানিয়েছি। একজন অন্যজনের কানে ধোকা-প্রতারণামূলক কথা সাজিয়ে গুছিয়ে ব্যক্ত করে।” (:১১২) 

 মুসনাদে আহমদে হযরত আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর নিকট হাজির হন। সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) মসজিদে অবস্থান করছিলেন। হযরত আবু যার (রাঃ) তার পাশে বসে পড়লেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃহে আবু যার (রাঃ)! তুমি নামায পড়েছো কি?” তিনি উত্তরে বললেনঃজ্বী, না।তখন তিনি বললেনঃতা হলে উঠে নামায পড়ে নাও।হযরত আবু যার (রাঃ) উঠে নামায পড়লেন। তারপর বসে পড়লেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেনঃহে আবু যার (রাঃ) মানবরূপী শয়তান হতে এবং দানবরূপী শয়তান হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর।হযরত আবু যার (রাঃ) বললেনঃহে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! মানুষের মধ্যেও কি শয়তান আছে? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃহ্যা”, হযরত আবু যার (রাঃ) জিজ্ঞেস। করলেনঃহে আল্লাহর রাসূল (সঃ) নামায কি?" তিনি জবাবে বললেনঃনামায খুব ভাল কাজ। যার ইচ্ছা কম পড়তে পারে এবং যার ইচ্ছা বেশী পড়তে পারে।হযরত আবু যার (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃহে আল্লাহর রাসূল (সঃ) রোযা কি?” তিনি জবাব দিলেনঃযথেষ্ট হওয়ার মত একটি ফরজ কাজ। আল্লাহর কাছে এর জন্যে বহু পুরস্কার রয়েছে। হযরত আবু যার (রাঃ) প্রশ্ন করলেনঃসাদকা কি?" তিনি উত্তরে বললেনঃসাদকা এমনই জিনিষ যার বিনিময় বহুগুণ বৃদ্ধি করে প্রদান করা হবে।হযরত আবু যার (রাঃ) আর করলেনঃহে আল্লাহর রাসূল (সঃ) কোন সাদকা সবচেয়ে উত্তম?” রাসূলুল্লাহ। (সঃ) উত্তর দিলেনঃসম্পদ কম থাকা সত্ত্বেও সাদকা করা, অথবা চুপে চুপে কোন ফকীর মিসকীন দুঃখী জনের সাথে উত্তম ব্যবহার করা।হযরত আবু যার (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃহে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! সর্বপ্রথম নবী কে ছিলেন?” তিনি জবাবে বললেনঃহযরত আদম (আঃ) ছিলেন প্রথম নবী।

 হযরত আবু যার (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃহযরত আদম (আঃ) কি নবী ছিলেন?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাব দিলেনঃহ্যা, তিনি নবী ছিলেন, এবং এমন ব্যক্তি ছিলেন যার সঙ্গে আল্লাহ তা'আলা কথাবার্তা বলেছেন।হযরত আবু যার (রাঃ) প্রশ্ন করলেনঃহে আল্লাহর রাসূল (সঃ) রাসূল কত জন ছিলেন?” তিনি উত্তরে বললেনঃতিনশত দশের কিছু বেশী, বলা যায় একটি বড় জামাআত।আবার এও বললেনঃতিনশত পনেরো।হযরত আবু যার (রাঃ) বললেনঃহে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার প্রতি নাযিলকৃত আয়াতসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশী বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আয়াত কোনটি?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাব দিলেনঃআয়াতুল কুরসী অর্থাৎ,(আরবি) এই আয়াতটি।” ( হাদীসটি ইমাম নাসায়ীও (রঃ) বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া ইমাম আবু হাতিম ইবনে হিব্বানও (রঃ) অন্য সনদে হাদীসটি দীর্ঘভাবে বর্ণনা করেছেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন) মুসনাদে আহমদে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক নবী (সঃ)-এর নিকট এসে বললোঃহে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার মনে এমন সব চিন্তা আসে যেগুলো প্রকাশ করার চেয়ে আকাশ থেকে পড়ে যাওয়াই আমার নিকট বেশী পছন্দনীয় (সুতরাং অবস্থায় আমি কি করবো?) নবী (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “(তুমি বলবে): (আরবি) অর্থাৎআল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান আল্লাহ তা'আলার জন্যেই সমস্ত প্রশংসা যিনি শয়তানের প্রতারণাকে ওয়াসওয়াসা অর্থাৎ শুধু কুমন্ত্রণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন, বাস্তবে কার্যে পরিণত করেননি।

 

قُلۡ  اَعُوۡذُ  بِرَبِّ النَّاسِ ۙ﴿۱﴾

বল, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি মানুষের প্রতিপালকের নিকট। رَبّ (প্রতিপালক) এর অর্থ হল যে, যিনি শুরু থেকেই -- মানুষ যখন মাতৃগর্ভে থাকে তখন থেকেই -- তার তত্ত্বাবধান লালন-পালন করতে থাকেন; পরিশেষে সে সাবালক জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে যায়। তাঁর এই কাজ শুধু কিছু সংখ্যক লোকের জন্য সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা সকল মানুষের জন্য ব্যাপক। আবার কেবলমাত্র সকল মানুষের জন্যই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তিনি সমস্ত সৃষ্টির প্রতিপালন করে থাকেন। এখানে কেবল 'মানুষ' শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে মানুষের সেই মান মর্যাদাকে ব্যক্ত করার জন্য যা সকল সৃষ্টির উপরে রয়েছে।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ