Header Ads Widget

হারানো মসজিদের না জানা ইতিহাস।

প্রথাগত ইতিহাস অনুযায়ী ১০০০ শতকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সুফিদের প্রথম আগমন ঘটে। সুফিদের মাধ্যমে পূর্ববাংলায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার শুরু হয় এবং তাঁদের হাতেই এই অঞ্চলে প্রথম মসজিদ নির্মাণ হয়। তাদের উদ্দেশ্যই বলা যায় ইসলামের ধারক ও বাহক আল্লাহ তায়ালা নিজেই কখন কোথায় কিভাবে তার দিনকে হেফাজত করেন তার একটি অনন্য নিদর্শন এখানে পাওয়া যায়। 

আমার বাসা থেকে ২ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত এই হারানো মসজিদটি। ১৯৮৭ সালের প্রথমভাগে স্থানীয়রা সাংবাদিক ও গবেষকদের কাছে হারানো মসজিদ সম্পর্কে অবহিত করেন। তখন শতাধিক গবেষক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদ এখানে গবেষণা করতে ছুটে আসেন। 

হারানো মসজিদের শিলালিপিটি


টাইগার ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা টিম স্টিল লালমনিরহাটের মসজিদটি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন। প্রথাগত ইতিহাস অনুযায়ী ১০০০ শতকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সুফিদের প্রথম আগমন ঘটে। ১১০০ থেকে ১২০০ শতকে সুফিদের মাধ্যমে পূর্ববাংলায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার শুরু হয় এবং তাঁদের হাতেই এই অঞ্চলে প্রথম মসজিদ নির্মাণ হয়। তাই এত আগে এখানে মসজিদ নির্মাণের বিষয়টি আশ্চর্যজনক। টিম স্টিল তখন আমেরিকান ইনস্টিটিউট অফ আর্কিওলজিস্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেখানকার ইসলামের ইতিহাস সংক্রান্ত গবেষকগণ বলেন অনেক রোমান ও জার্মান ইতিহাসবিদের লেখায় আরব ও রোমান বণিকদের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় নৌ-বাণিজ্যের সূত্রে আসা-যাওয়ার কথা জানা যায়। এছাড়া বেশ কয়েকটি চলমান গবেষণায় ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা অববাহিকাকে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার প্রমাণও পাওয়া গেছে। টিম স্টিল পঞ্চগড়ের ভিটাগড়ে প্রাচীন নগরের নিদর্শন পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যাপক শাহনেওয়াজের গবেষণা থেকেও সহায়তা পান। তিনি মনে করেন মসজিদটি নির্মাণের ইতিহাস খুঁজে পেলে হয়তো বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ইতিহাসের সঙ্গে বিশ্ব সভ্যতার সম্পর্কের আরেক ইতিহাস জানার পথ উন্মোচিত হবে।

হারানো মসজিদের বর্তমান চিত্র


বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলায় ৬৯ হিজরি সনে নির্মিত একটি মসজিদের সন্ধান পাওয়া গেছে। মসজিদটির কেবল ধ্বংসাবশেষ অবশিষ্ট থাকায় এটি স্থানীয়ভাবে হারানো মসজিদ নামে পরিচিত। এই মসজিদটিকে বাংলাদেশের তথা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো মসজিদ বলে ধারণা করা হয়। এই মসজিদের নতুন নামকরণ করা হয়েছে সাহাবায়ে কেরাম মসজিদ। 


অবস্থানঃ

সুপ্রাচীন এই মসজিদটি রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়কের ১ কিলোমিটার দক্ষিণে লালমনিরহাট সদর উপজেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাস মৌজায় অবস্থিত। 


ইতিহাসসম্পাদনাঃ

লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাস মৌজায় বহুদিন ধরে একটি পতিত জঙ্গল ছিল। জঙ্গলের নাম ছিল মজদের আড়া। স্থানীয় ভাষায় আড়া শব্দের মানে জঙ্গলময় স্থান। জঙ্গল পরিষ্কার করার সময় প্রাচীনকালের কিছু ইট বেরিয়ে আসে। এমনিভাবে মাটি ও ইট সরাতে গিয়ে একটি মসজিদের ভিত খুঁজে পাওয়া যায়। এখানের একটি প্রচিীন শিলালিপির পাঠ থেকে মসজিদের প্রতিষ্ঠাকাল ৬৯ হিজরি জানা গেছে। 


শিলালিপিসম্পাদনাঃ

শিলালিপিসম্পাদনা মসজিদের ধ্বংসস্তূপের ভিতরে ৬’’×৬’’×২’’ আকারের একটি শিলালিপি পাওয়া যায়। লিপিটিতে আরবি ভাষায় ষ্পষ্টাক্ষরে লেখা আছে “লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ, হিজরি সন ৬৯”।  লিপিটি থেকে বোঝা যায় যে মসজিদটি প্রায় ৬৮৯ খ্রিস্টাব্দের দিকে নির্মিত হয়েছিল। শিলালিপিটি বর্তমানে রংপুরের তাজহাট জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। 



স্থাপত্যশৈলীসম্পাদনাঃ

মসজিদটি ২১ ফুট চওড়া এবং ১০ ফুট লম্বা ছিল। এর চারটি স্তম্ভ ছিল, যার দুটি সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত। 


বিস্তারিত জানিঃ - 

বাংলায় মুসলিম আগমনের প্রসঙ্গ এলে সবার আগেই আসে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির কথা। তবে তারও আগে একাদশ শতাব্দীতে সুফিদের আগমন ঘটেছিল। লালমনিরহাটে পাওয়া একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ বলছে এর নির্মাণকাল ৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে। মসজিদটি কারা নির্মাণ করেছে তা নিয়ে প্রত্তানত্ত্বিক ও গবেষকরা অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন। এই অনুসন্ধান কার্যক্রম নিয়ে লিখেছেন আন্দালিব আয়ান

গ্রামের নাম রামদাসঃ

রাস্তার একপাশে দিগন্ত বিস্তৃত সারি সারি ফসলের মাঠ। আরেক পাশে জনবসতি। তবে মোটেও ঘনবসতিপূর্ণ নয় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাস গ্রামটি। হাজার বছর আগে এই গ্রামে কি কোনো জনবসতি ছিল?

এই প্রশ্নের কোনো উত্তর না পাওয়া গেলেও, এই গ্রামেই মিলেছে এক অত্যাশ্চর্য মুসলিম নিদর্শন। প্রায় ১৩৭২ বছর আগে এই গ্রামেই নির্মিত হয়েছিল একটি মসজিদ। ধারণা করা হচ্ছে, এই মসজিদটিই এখন দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো মুসলিম নিদর্শন। কিন্তু এত বছর আগে এখানে মসজিদ কী করে এলো তা প্রাথমিক অবস্থায় প্রত্নতাত্ত্বিকদেরও অবাক করে দিয়েছিল।

সামনে ফসলের মাঠটি একসময় ছিল চকচকার বিল। এলাকার প্রবীণ মানুষের কাছে স্থানটি আজও সাগরের ছড়া নামে পরিচিত, যার অনতিদূরে তিস্তা নদীর অবস্থান। ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা অববাহিকাকে বলা হয় পৃথিবীর প্রাচীনতম অববাহিকাগুলোর একটি। তাই এই অববাহিকায় ৬৯ হিজরি বা ৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে একটি মসজিদ নির্মাণের ঘটনা বিস্ময় জাগানিয়া হলেও একেবারে অস্বাভাবিক নয়। শৌখিন ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক টিম স্টিলও তেমনটাই মনে করেন। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলজুড়ে যে প্রাচীন সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব সময় থেকে গড়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে প্রাচীন রোমান ও আরব সভ্যতার সম্পর্ককে ইতিহাসের স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই দেখেন প্রত্তানত্ত্বিক গবেষক টিম স্টিল। সভ্যতার সঙ্গে সভ্যতার এই সম্পর্কের সূত্র ধরেই আরব বণিকেরা লালমনিরহাটের ওই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন এমনটাই মনে করেন তিনি।

হারানো মসজিদের বর্তমান চিত্র


সাহাবি আবু আক্কাস (রাঃ)-

সহস্র বছরের পুরনো মসজিদের অস্তিত্ব সাড়া ফেলেছিল রামদাস গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে। যেখানে মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে সেখানেই তারা গড়ে তুলেছে নতুন আরেকটি মসজিদ। এই মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে ‘হারানো মসজিদ’। স্থানীয় অধিবাসী এবং ‘হারানো মসজিদ কমিটি’র সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যক্তির দাবি অনুযায়ী, ধ্বংস হয়ে যাওয়া মসজিদটি নির্মাণ করেছেন মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর একজন সাহাবা। যিনি এই অঞ্চল দিয়ে চীনে পাড়ি জমিয়েছিলেন। চীনের বিস্মৃত কোয়াংটা নদীর ধারে কোয়াংটা শহরে তার নির্মিত মসজিদ ও সমাধি রয়েছে। ওই সাহাবির নাম আবু আক্কাস (রা.)।

যেভাবে আবিষ্কৃত হয় ধ্বংসাবশেষঃ

বর্তমানের হারানো মসজিদ কমপ্লেক্স যে স্থানে অবস্থিত, সেই স্থানটি এক সময় পরিচিত ছিল মোস্তের আড়া বা মজদের আড়া নামে। স্থানীয় অধিবাসীরা জানান, স্থানটি টিলার মতো ছিল। ওখানে কেউ যেত না। তবে অনেকেই আগরবাতি, মোমবাতি, ফুল, ধূপ ইত্যাদি ওই স্থানে রেখে আসত। এখানে মসজিদ, মন্দির না অন্য কিছু আছে কিছুই জানত না তারা। উল্লেখ্য,  স্থানীয় ভাষায় আড়া শব্দের অর্থ হলো জঙ্গলময় স্থান। দীর্ঘদিনের পতিত এই জঙ্গলে স্থানীয় লোকজন হিংস্র জীবজন্তু, সাপ-বিচ্ছু ইত্যাদির ভয়ে ভেতরে প্রবেশ করত না।

জানা যায়,  রামদাস এলাকায় বর্তমানে যারা বাস করছেন,  তাদের পূর্বপুরুষরা ২০০ বছর আগে এখানে বসতি শুরু করেন। হারানো মসজিদ কমপ্লেক্স যা আগে আড়া নামে পরিচিত ছিল, এক সময় তার মালিক ছিলেন পচা দালাল নামে এক ব্যক্তি। পরে তার কাছ থেকে এই আড়া কিনে নেন ইয়াকুব আলী। এই কেনা-বেচাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল আনুমানিক ১৯৪৯ সালে। পরে উত্তরাধিকার সূত্রে জায়গাটির মালিক হন নবাব আলী। হারানো মসজিদ আবিষ্কারের পর তিনি জায়গাটা হারানো মসজিদ কমপ্লেক্সের নামে দিয়ে দেন।

এই মসজিদের রহস্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে গবেষকরা আরও জানতে পারেন, মসজিদটি যেখানে ছিল সেই মজদের আড়ায় চাষাবাদ করার জন্য খোঁড়া শুরু হয় ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে। টিলাটি সমতল করার জন্য খোঁড়া শুরু হলে এখানে প্রচুর ইট পাওয়া যায়। এসব দেখে স্থানীয় লোকজন ধারণা করে,  পুরনো কোনো জমিদার কিংবা রাজরাজড়ার বাড়ি হয়তো এখানে ছিল। এ কারণে তারা ওইসব ইট নিয়ে কোনো প্রকার সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেননি। যে যার মতো ভাঙা ইটের টুকরো নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গেছেন এবং বেশিরভাগ ইট নিজেদের বাড়িঘরের কাজে লাগিয়েছেন। কিন্তু একটা ঘটনায় পাল্টে যায় পুরো ঘটনাচক্র।

‘ছিটকে পড়া’ ইটের কাহিনীঃ

একটা ইটের ছিটকে পড়ার ঘটনার মধ্য দিয়েই মজদের আড়ায় আবিষ্কৃত হয় ৬৯ হিজরি বা ৬৪৮ খ্রিস্টাব্দের হারানো মসজিদ। স্থানীয় অধিবাসী আফছার আলী বলেন, ‘আমরা ঘটনাটিকে অলৌকিক বলেই মনে করি। ঘটনাটা হলো, আইয়ুব আলী নামে রামদাস গ্রামের এক বাসিন্দা অন্য অনেকের মতো মজদের আড়া থেকে ইট কুড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে যান। এক পর্যায়ে কুড়িয়ে নেওয়া ইটগুলোকে তিনি পরিষ্কার করছিলেন। কিন্তু এমন সময়ই তিনি দেখতে পান গাদা করে রাখা ইটের স্তূপ থেকে একটি ইট যেন আলাদাভাবে ছিটকে পড়েছে। তিনি আশ্চর্য হন এবং কৌতূহল বোধ করেন। ছিটকে পড়া ইটের গায়ে কী যেন লেখা দেখতে পান আফসার আলী। টিউবওয়েলের পানিতে ইটটা ভালো করে ধুয়ে নেন। তারপর কয়েকজন মিলে এটি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখতে পান, ওই ইটটি একটি প্রাচীন শিলালিপি, যার আকার ৬"৬"২। এর ওপরে স্পষ্টাক্ষরে লেখা, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, হিজরি সন ৬৯’। এই ঘটনায় স্থানীয় লোকদের মনে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে,  এটা কোনো হারানো মসজিদের ধ্বংসাবশেষ।

অলৌকিক কাহিনীঃ

ওই ঘটনার পর তখনো মজদের আড়ায় নামাজ পড়া শুরু হয়নি। এক রাতে আফছার আলী শুনতে পান তার ভায়রা ভাই নওয়াব আলীর মতো কণ্ঠে একজন বলছেন, ‘চলো, আমরা মজদের আড়ায় নামাজ পড়ি। এমন আহ্বান শুনে রাতের বেলায়ই নামাজ পড়ার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন আফছার আলী। একসময় পৌঁছে যান ভায়রার বাড়িতে। ভাবছিলেন ভায়রা হয়তো বেরিয়ে আসবেন নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দেখা গেল ভায়রা ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। পরে তাকে ডাকাডাকি শুরু করেন আফছার এবং বলেন, নামাজ পড়ার জন্য ডেকে নিয়ে এসে তুমি আর বেরোচ্ছ না কেন? এ কথা শুনে নওয়াব আলী তাজ্জব বনে যান। ঘটনাটা এলাকায় জানাজানি হলে, সবাই মিলে ওই দিন থেকেই ধ্বংসাবশেষের স্থানে নামাজ পড়া শুরু করেন। এলাকাবাসীর মতে, অলৌকিক ওই ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৮৬ সালের দিকে। ওই দিন ছিল মহররমের ১০ তারিখ। পরবর্তী সময়ে এখানেই নির্মাণ করা হয় হারানো মসজিদ কমপ্লেক্স এবং একটি নূরানী মাদ্রাসা।

হারানো মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মাণের আগে রামদাস গ্রামের মানুষেরা নামাজ পড়ত তিন কিলোমিটার দূরের সুবেদার মুনছুর খাঁ নিদাঁড়িয়া মসজিদে,  যা একই ইউনিয়নের নয়ারহাট পাড়ায় অবস্থিত। এই মসজিদটি মোগল আমলের স্থাপত্যকীর্তির সাক্ষ্য বহন করছে। অবশ্য এটিও দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল। স্থানীয় লোকজন গরু খুঁজতে গিয়ে এই মসজিদটি জঙ্গলের ভেতর খুঁজে পায়। অবশ্য এলাকাবাসী তারও আগে ছয় থেকে সাত কিলোমিটার দূরের রতিপুরের কেরামতিয়া বড় মসজিদে নামাজ পড়তে যেত।

শিলালিপির সূত্র ধরে অনুসন্ধানঃ

যে শিলালিপির বর্ণনা থেকে হারানো মসজিদকে ৬৯ হিজরির বলা হচ্ছে, সেই শিলালিপি এখন নানা হাত ঘুরে রংপুরের তাজহাট জমিদারবাড়ির জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। শিলালিপিটি রামদাস গ্রামের অধিবাসীদের কাছ থেকে নিয়ে যান কুড়িগ্রামের একজন সাংবাদিক। তার কাছ থেকে পরবর্তী সময়ে সংগ্রহ করে এটি সংরক্ষণের জন্য রাখা হয় রংপুরের তাজহাট জমিদারবাড়ি জাদুঘরে। উল্লেখ্য, ১৯৯৩ সালে রংপুরের টাউন হলে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। যার বিষয় ছিল ‘হিজরি প্রথম শতাব্দীতে ইসলাম ও বাংলাদেশ’। এতে সভাপতিত্ব করেন কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল কুদ্দুস বিশ্বাস। ওই সেমিনারে উপস্থিত সব আলোচক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, ৬৯ হিজরি অর্থাৎ ৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে সাহাবায়ে কেরামগণ কর্র্তৃক এই হারানো মসজিদ নির্মাণ করা মোটেই অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু নিশ্চিতভাবে কে বা কারা এই মসজিদ নির্মাণ করেছে তার কোনো হদিস মিলছিল না।

টিম স্টিল-এর অনুসন্ধানঃ

কর্মসূত্রে টিম স্টিল তখন বাংলাদেশের টাইগার ট্যুরিজম নামের একটি পর্যটন উন্নয়নবিষয়ক প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা। যুক্তরাজ্যের সাউথ ওয়েলসে স্ত্রী ক্রিস্টিন ও দুই মেয়ের সঙ্গে ছুটি কাটিয়ে বাংলাদেশে ফিরেছেন তিনি। শিলালিপি উদ্ধারের খবর শুনে ছুটে গেলেন লালমনিরহাটে। খুঁজে বের করলেন প্রাচীন মসজিদটি। তিনি বাংলা ও উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাস তন্ন তন্ন করে খুঁজতে শুরু করলেন। ৬৪৮ সালে কে কেন লালমনিরহাট এলাকায় ওই মসজিদ নির্মাণ করল তা খুঁজতে আটঘাট বেঁধে নেমে গেলেন। যোগাযোগ করলেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও প্রত্তানত্ত্বিক অধিদপ্তরের সঙ্গে। কিন্তু তাদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। বেশিরভাগ প্রত্তানত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদ বললেন, এত আগে ওই অঞ্চলে মসজিদ নির্মিত হওয়ার কথা না। বাংলার ইসলাম বিস্তারের ইতিহাস হিসেবে বেশিরভাগ মতই জানায়, একাদশ শতকে চট্টগ্রামে সুফিদের প্রথম আগমন ঘটে। পরে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত তাদের হাত ধরে পূর্ববাংলায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটে। তাদের হাতেই এই অঞ্চলে প্রথম মসজিদ নির্মাণ হয়। পরে সুলতান ও মোগলদের হাত ধরে তার আরও প্রসার ঘটে।

লালমনিরহাটের এক প্রত্যন্ত গ্রামে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ রয়েছে, এটা প্রমাণের জন্য টিম স্টিল সহায়তা নিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্তানত্ত্বিকদের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিওলজিস্ট। সেখানকার ইসলামের ইতিহাস ও প্রত্তানত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে গবেষণা করেন এমন সব গবেষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তারা বললেন হ্যাঁ,  হতে পারে। কেননা, রোমান ও জার্মান অনেক ইতিহাসবিদের লেখায় আরব ও রোমান বণিকদের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় নৌ-বাণিজ্যের সূত্রে আসা-যাওয়ার কথা লিপিবদ্ধ আছে। আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিওলজি টিম স্টিলকে জানায়, তাদের বেশ কয়েকটি চলমান গবেষণায় ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা অববাহিকাকে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার প্রমাণও পাওয়া গেছে।

ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পাড় ধরে সিকিম হয়ে চীনের ভেতর দিয়ে আরব বণিকদের বাণিজ্য বহরের যাতায়াতের অনেক প্রমাণও টিমের হাতে আসে। টিমের গবেষণায় আরও প্রমাণ মেলে খ্রিস্টপূর্ব সময় থেকে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা দিয়ে চীন ও ভারতবর্ষ থেকে রোমান ও আরবরা পণ্য নিয়ে যেত। রোমানদের সঙ্গে বাংলার যোগাযোগের আরও প্রমাণ তিনি পান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্তনত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের উয়ারী-বটেশ্বর সভ্যতা নিয়ে গবেষণায়। নরসংদী থেকে কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে প্রাচীন নগর-সভ্যতার যে নিদর্শন মোস্তাফিজুর রহমান পেয়েছেন, তাতে এটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে পড়ছে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন সভ্যতাগুলোর সমসাময়িক সভ্যতা বাংলাদেশ ভূখণ্ডে গড়ে উঠেছিল। পঞ্চগড়ের ভিটাগড়ে প্রাচীন নগরের নিদর্শন পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যাপক শাহনেওয়াজের গবেষণা থেকেও সহায়তা পান টিম। বগুড়ার মহাস্থানগড় বা নওগাঁর প্রাচীন মসজিদ এই সবকিছুকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে গড়ে ওঠা প্রাচীন-সভ্যতার ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখতে চান টিম স্টিল। এই শৌখিন প্রত্নতাত্ত্বিক ১৯৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশের ইতিহাস অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে জীবনের আরেক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন। লালমনিরহাটে দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন মসজিদের খোঁজ পেয়ে এই অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার যে নেশা তাকে পেয়ে বসেছে তা থেকে মুক্ত হতে চান না তিনি। তাই তো নিজ উদ্যোগে ও খরচে চালিয়ে যাচ্ছেন তার শখের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা।

বাংলাদেশের ওই হারানো মসজিদের ওপর আরও গবেষণা হওয়া উচিত এই আকুতি রেখে টিম বলেন, ওই মসজিদ নির্মাণের ইতিহাস খুঁজে পেলে হয়তো বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ইতিহাসের সঙ্গে বিশ্ব সভ্যতার সম্পর্কের আরেক ইতিহাস জানার পথ খুলে যাবে। রোমান,  চৈনিক,  আরব আর বাংলা এই চার অঞ্চলের প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্ক জানা গেলে হয়তো বাংলার ইতিহাস অন্যভাবে লিখতে হবে। টিম স্টিলের গবেষণায় প্রতীয়মান হচ্ছে, এটি এক হাজার ৩৭২ বছর আগের মসজিদ! যার সূত্র ধরে পাল্টে যাবে দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিমদের আগমনের ইতিহাসও।


অন্যান্য সুত্রঃ

Harano Masjid

https://maps.app.goo.gl/xcCAEPyw865x8ARh7

Al Jazeera English

https://youtu.be/D7zy_hTIyNA


ইউকিপিডিয়া

shorturl.at/mwBLX


Lalmonirhat 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ